রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ১০:৪২ পূর্বাহ্ন

দূরদর্শী নেতৃত্বের বিকল্প নেই

দূরদর্শী নেতৃত্বের বিকল্প নেই

মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন:

নেতৃত্ব আল্লাহ প্রদত্ত। শূন্যতার মধ্যে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আবির্ভাব হয় নেতৃত্বের। নেতৃত্ব ছাড়া কোনো পরিবার চলে না, সমাজ চলে না; চলে না রাষ্ট্রও। নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও ক্যারিশমাতেই জন্ম হয় রাজনৈতিক দলের, জন্ম হয় রাজনৈতিক শক্তিরও। উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলের কার্যকারিতা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক দল হলো একটি প্রবহমান নদীর মতো। নদীর উপকারিতা যেমন প্রভ‚ত, তেমনি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তাও।

আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে ভেতর থেকে বদলে দিতে হবে। কেননা নেতৃত্ব সঙ্কটে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এখন মরা নদীর মতো হয়ে গেছে। দলগুলোর ভেতর কোনো প্রাণ নেই; নেই জনগণের মধ্যে দলগুলোর কোনো আবেদন। এ সময় যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বকে উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সামনে এগিয়ে নিতে হবে। সেটি হচ্ছে না বলে রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়ে পড়েছে অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন। আজকের রাজনীতি কোনো কিছুরই সমাধান দিতে পারছে না, প্রশাসনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে চলছে রাষ্ট্র। আমরা যদি দেশকে উন্নত, আধুনিক ও মধ্যম আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করতে চাই; তা হলে প্রয়োজন সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের, যে নেতৃত্ব দেখতে পারে ভবিষ্যতের রূপরেখা।

বাংলাদেশের লক্ষ্য কী, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কিভাবে আসবে, অর্থনীতির আকার, শিল্প ও কৃষি উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে- সর্বোপরি জাতি গঠন ও সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টিসহ জাতীয় জীবনের সব বিষয়ে নেতৃত্বের সম্যক ধারণা থাকতে হবে। এমন দূরদর্শী নেতৃত্বই বিভক্তি, বিভাজন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে আমরা লক্ষ করছি সুবিধাবাদী, অদূরদর্শী এবং বিভাজন, হানাহানি ও একে অন্যকে খাটো করার রাজনীতি, যা উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক হতে পারে না।

দৃশ্যত আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেই। দলগুলো পরিচালিত হয় কার্যত এক ব্যক্তির অঙ্গুলি হেলনে। আর অভিযোগ আছে টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয় দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি। এমন ঘুণে ধরা, সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতি দিয়ে কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের আশা যায় না। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতৃত্বের পরিবর্তন যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী নেতৃত্বও।

শরীরে নতুন রক্ত তৈরি না হলে যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি নতুন নেতৃত্ব তৈরি না হলে রাজনৈতিক দলেরও বিকাশ ঘটে না, বিকাশ ঘটে না নেতৃত্বেরও। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যেন মরা নদীর মতো, এটি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ সব রাজনৈতিক দলের জন্যই সত্য। তাই এখানে রাজনীতি বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। একটি বড় দল সরকার চালাচ্ছে প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আর অন্য বড় দলটির অবস্থা না ঘরকা না ঘাটকা। তাদের রাজনীতি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, কেন? উত্তর একটাই নেতৃত্ব। দলটির ভেতর নতুন কোনো নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না বা গড়ে ওঠার মতো সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে না। অভিযোগ আছে, দল পুনর্গঠনের নামে হয় টাকা-পয়সা লেনদেনের খেলা। তাই রাজপথে দলটির কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায় না, কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে তারা ঘরে বসে আরাম-আয়েশে সময় কাটান। এমন সুবিধাবাদী ও অদূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে ভালো কিছু অর্জন কী সম্ভব? এসব মানুষ এখন বোঝে আর বোঝে বলেই সুবিধাবাদী নেতৃত্বের পেছনে তারা দাঁড়াচ্ছে না। ফলে রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তনও হচ্ছে না।

প্রতিটি প্রজন্মেই একজন দেশপ্রেমিক নেতা থাকেন, যিনি ভিন্ন কিছু করেন। চেষ্টা না করার চেয়ে ঝুঁকি নিয়ে হেরে যাওয়া অনেক ভালো। ১৭৭৫ সালের মার্চে প্যাট্রিক হ্যানরি যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে আমাদের লড়তে হবে। দ্বিধা ও নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে কখনো শক্তি অর্জন করা যায় না। জীবন কি এতই প্রিয় কিংবা শান্তি কি এতই মধুর যে, শিকল ও দাসত্বের বিনিময়ে তা ক্রয় করতে হবে?

নেতৃত্ব যখন প্রত্যয়ের চেয়ে সুবিধাকে বেছে নেয়, তখন রাজনীতির অবনতি ঘটে, রাজনীতি হয় কলুষিত, কলুষিত হয় নেতৃত্বও। আর জনগণের কাছে এই কলুষিত ও বিতর্কিত নেতৃত্বের কোনো আবেদন থাকে না, তাদের ডাকে জনগণ সাড়াও দেয় না; বাস্তবেও আমরা তাই দেখছি।

উৎসর্গ মানে সবসময় হারানো নয়, বরং বেছে নেয়ার চেয়ে বেশি কিছু। এর অর্থ হলো- বৃহত্তর অর্জনের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন। মহৎ নেতৃত্ব বিরক্তি নয়, বরং স্বেচ্ছায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলে দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। যারা দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করেন, তারা জীবিতদের মধ্যে জীবনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেন। দেশকে ভালোবাসার মানে সামাজিক ত্রুটির প্রতি অন্ধত্ব কিংবা সামাজিক বিশৃঙ্খলার প্রতি বধিরতা। পরিবার ও জাতির জন্য ত্যাগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যখন পরিবারের জন্য ত্যাগ করে তখন সে পরিবার লাভবান হয়। কোনো ব্যক্তি যখন জাতির জন্য কিছু করে তখন সে জাতি চিরতরে কিছু অর্জন করে। আত্মস্বার্থ ও উৎসর্গের মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হলে দ্বিতীয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই; নেই সফলতার কোনো সহজ, নির্বিঘ্ন পথ।

আমরা নৈতিক রক্তাল্পতা ও আত্মিক ক্যান্সারে ভুগছি। সৎ ও ন্যায়বান লোকেরা দুর্নীতি ও আর্থিক অপুষ্টির মধ্যখানে পরিহাসের পাত্রে পরিণত হয়েছে। যারা জাতির সাথে প্রতারণা করে তারা নিকৃষ্টতম অপরাধী। পতিতাবৃত্তি সামাজিকভাবে নিন্দনীয় হলেও একজন পতিতা কিন্তু তার বেঁচে থাকার তাগিদে দেহ বিক্রি করে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারক নেতৃত্বের কবলে পুরো জাতিই বিক্রি হয়ে যায়। কোনটি নিকৃষ্টতর? বেঁচে থাকার তাগিদে শরীর বিক্রি না বিবেক অগ্রাহ্য করে জাতি বিক্রি?

জেলিফিশ মাঝে মধ্যে শামুক গিলে নেয় এবং যতক্ষণ পর্যন্ত শামুকটি শক্ত খোলসে থাকে ততক্ষণ সে বেঁচে থাকে। কিন্তু টিকে থাকার জন্য তার খাবারের প্রয়োজন। তাই সে জেলিফিশের ভেতরটুকু খেতে শুরু করে এবং ক্রমেই বাড়তে থাকে। সত্যের প্রকৃতি এমনই। এসব কিন্তু রূপকথা নয়। সব সময় ঘরের শত্রু সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। বিশ্বাসঘাতকরা দুই প্রকারের হয়, সক্রিয় বিশ্বাসঘাতক ও নিষ্ক্রিয় বিশ্বাসঘাতক। সক্রিয় বিশ্বাসঘাতকের স্বীয় লাভের জন্য মাতৃভ‚মিকে বাজারে বিক্রি করে দেয়। আর নিষ্ক্রিয় বিশ্বাসঘাতকরা মাতৃভ‚মিকে বিক্রি করা দেখেও নীরব থাকে।

আমরা শুনি, ক্ষমতা দূষিত করে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সম্পূর্ণ দূষণ সম্পন্ন করে। এ কথা সত্য নয়, ক্ষমতা তাদেরকেই দূষিত করতে পারে, যারা দূষণযোগ্য। ক্ষমতা কেবল অন্তরালবর্তীকে সামনে এনে দেয়। ক্ষমতা নিরপেক্ষ। সৎ লোকের হাতে ক্ষমতা আশীর্বাদস্বরূপ আর অধার্মিকের হাতে তা অভিশাপ, অনেকটা বৃষ্টি হলে আগাছা আর ফুল উভয়েই যেমন বাড়তে থাকে।

প্রায় তিন হাজার বছর আগে গ্রিক সভ্যতার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক ও দার্শনিকরা বিধান দিয়েছিলেন যে, (আদর্শ রাষ্ট্রে) দার্শনিক রাজার না থাকবে কোনো পরিবার, না থাকবে কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ। পরিবার না থাকলে আত্মীয়স্বজন বা সন্তান-সন্ততির প্রতি তার কোনো সময় দুর্বলতা জন্মাবে না। কেনো ব্যক্তিগত সম্পদে অধিকার না থাকলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারে তিনি নিজে নিজেই উদ্বুদ্ধ হবেন।

বলতে কোনো দ্বিধা নেই, আমরা একটি গভীর রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। একটি রাজনৈতিক ট্র্যাকে আমাদেরকে ফেলে দেয়া হয়েছে। আমাদের সম্ভাবনার জায়গাগুলো শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে না, কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমাদের জাতীয় জীবনকেও। এখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারলে, আমাদের ভবিষ্যৎ হবে অন্ধকার। আমাদের সুন্দর স্বপ্নগুলো পরিণত হবে দুঃস্বপ্নে। আমরা পরিণত হবো পরমুখাপেক্ষী এক জাতিতে। একটি বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বই এখান থেকে আমাদেরকে বের করে আনতে পারে। বের করে আনতে পারে দেশকেও।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রকৃতি হতে হবে উদারনৈতিক। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিত্ব হতে হবে সৃজনমুখী, সংবেদনশীল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জনগণের আমানত হিসেবে গণ্য করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের প্রভাব, বৈভব বা প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে না। কোথাও কোনো পর্যায়ে কোনো বিচ্যুতি ঘটলে ঠিক তখনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিত্যাগ করার মানসিকতা তাদের অর্জন করতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877